বাংলাদেশে কেয়ার গিভারের চাহিদা

বাংলাদেশে কেয়ার গিভারের চাহিদা

বর্তমান অবস্থা, কারণ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্তমান যুগে স্বাস্থ্যসেবা ও মানবিক সহায়তার গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এখন কেয়ার গিভার (Caregiver) পেশার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। আগে যেখানে পরিবারেই বৃদ্ধ বা অসুস্থ সদস্যদের যত্ন নেওয়া হতো, এখন সময়ের পরিবর্তনে মানুষ কর্মব্যস্ত, শহুরে জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে, বৃদ্ধ, অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যত্ন নেওয়ার জন্য পেশাদার কেয়ার গিভারদের প্রয়োজনীয়তা ক্রমবর্ধমান। এই আর্টিকেলে আমি সোহেল রানা আলোচনা করবো— বাংলাদেশে কেয়ার গিভারের চাহিদা কেন বাড়ছে, কোন কোন সেক্টরে কাজ পাওয়া যায়, বেতন কাঠামো কেমন, এবং ভবিষ্যতে এই পেশার সম্ভাবনা কতটা।


কেয়ার গিভার কী ও তাদের কাজের ধরন

কেয়ার গিভার বা পরিচর্যাকারী হলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি অন্য একজনের দৈনন্দিন কাজকর্মে সহায়তা করেন — যেমন তাকে খাওয়ানো, ওষুধ দেওয়া, গোসল করানো, বিছানা থেকে উঠতে সাহায্য করা, হাঁটতে সহায়তা করা, বাথরুমে যেতে সহযোগিতা করা অথবা মানসিকভাবে সাপোর্ট করা।

বাংলাদেশে বর্তমানে কেয়ার গিভাররা কাজ করেন মূলত নিচের তিনটি ক্ষেত্রে —

  1. 🏠 হোম কেয়ার (Home Care) – বাসায় অসুস্থ, বৃদ্ধ বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যত্ন নেওয়া।
  2. 🏥 হাসপাতাল কেয়ার (Hospital Care) – হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সহকারী হিসেবে কাজ করা।
  3. 👵 সিনিয়র কেয়ার (Elderly Care) – বৃদ্ধ ব্যক্তিদের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও মানসিক যত্ন নেওয়া।

বাংলাদেশে কেয়ার গিভারের চাহিদা কেন বাড়ছে?

  1. পরিবারের কাঠামোর পরিবর্তন: বাংলাদেশে আগে ছিল যৌথ পরিবার, যেখানে একাধিক সদস্য মিলে বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তির যত্ন নিতেন। এখন শহরাঞ্চলে ছোট পরিবার বা একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে পরিবারের কেউ সময় দিতে না পারায় কেয়ার গিভারের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।
  2. নারীদের কর্মজীবনে যুক্ত হওয়া: আগে গৃহিণীরাই বেশি সময় ঘরে থেকে বয়স্ক বা অসুস্থ সদস্যের যত্ন নিতেন। এখন অধিকাংশ নারী চাকরি বা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাই, পেশাদার কেয়ার গিভারের প্রয়োজনীয়তা এখন পরিবারে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
  3. বিদেশফেরত বৃদ্ধ পিতা-মাতার যত্ন: অনেক পরিবারে সন্তানরা বিদেশে থাকে, আর তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা দেশে একা থাকেন। এসব ক্ষেত্রে কেয়ার গিভার নিয়োগ দেওয়া হয় যেন তারা বাবা-মার যত্ন সঠিকভাবে নিতে পারেন।
  4. হাসপাতাল ও ক্লিনিক সেবার বিস্তার: ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ বড় বড় শহরগুলোতে অসংখ্য হাসপাতাল ও ক্লিনিক গড়ে উঠছে। এসব প্রতিষ্ঠানে রোগীর পাশে পেশাদার কেয়ার গিভারের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
  5. বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধি: বাংলাদেশে বর্তমানে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে জনসংখ্যার হার প্রায় ৮% এবং এটি দ্রুত বাড়ছে। বয়স্কদের নিয়মিত যত্ন, ওষুধ, মানসিক সাপোর্ট — এসব দিতে প্রশিক্ষিত কেয়ার গিভার অপরিহার্য।

বাংলাদেশে কেয়ার গিভারের কর্মক্ষেত্র

বাংলাদেশে কেয়ার গিভাররা বর্তমানে নিচের সেক্টরগুলোতে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন —

  • প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক
  • হোম কেয়ার সার্ভিস কোম্পানি (যেমন EverTrust Home Care, Sheba XYZ, Patient Aid ইত্যাদি)
  • NGO ও সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান
  • বৃদ্ধাশ্রম বা নার্সিং হোম
  • বিদেশে কেয়ার গিভার চাকরি (বিশেষ করে জাপান, কানাডা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য)

কেয়ার গিভারের বেতন কাঠামো

বাংলাদেশে কেয়ার গিভারের বেতন নির্ভর করে কাজের ধরন, অভিজ্ঞতা ও কর্মস্থলের ওপর। সাধারণত বাসায় ফুলটাইম কেয়ার গিভারের বেতন ১৫,০০০ – ২৫,০০০ টাকা। হাসপাতালে শিফট অনুযায়ী ১৮,০০০ – ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত, আর প্রশিক্ষিত কেয়ার গিভার ২৫,০০০ – ৪০,০০০+ আয় করতে পারেন।

বিদেশি বা VIP কেসে: পার্টটাইম কেয়ার গিভার ৮,০০০ – ১৫,০০০ টাকা পান। বিদেশে (যেমন জাপান, কানাডা, মালয়েশিয়া বা সৌদি আরব) কেয়ার গিভার হিসেবে কাজ করলে মাসে ১,৫০,০০০ – ২,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয় সম্ভব।

কেয়ার গিভার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা

  1. ন্যূনতম এসএসসি পাস বা সমমান শিক্ষা।
  2. কেয়ার গিভার ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করা।
  3. বাংলাদেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা ১–৩–৬–৯ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়।
  4. ভালো আচরণ, সহানুভূতি ও ধৈর্য।
  5. প্রাথমিক চিকিৎসা ও ফার্স্ট এইড জ্ঞান।
  6. সময়নিষ্ঠতা ও দায়িত্ববোধ।

বাংলাদেশে কেয়ার গিভার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান

  • EverTrust Home Care Limited (Dhaka)
  • BRAC Skills Development Programme (SDP)

এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, যা চাকরি পাওয়ার সময় বড় সুবিধা দেয়।

বিদেশে কেয়ার গিভার চাকরির সুযোগ

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অনেক তরুণ-তরুণী জাপান, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে কেয়ার গিভার হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছেন। বিশেষ করে জাপানে "Technical Intern Training Program (TITP)" এর মাধ্যমে কেয়ার গিভার পাঠানো হচ্ছে। সরকারও BMET ও NSDC Bangladesh-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ও বিদেশে কর্মসংস্থান প্রকল্প চালু করেছে।

বাংলাদেশে কেয়ার গিভার সার্ভিস কোম্পানিগুলোর ভূমিকা

  • EverTrust Home Care: পেশেন্ট কেয়ার সার্ভিস ও বিদেশে প্লেসমেন্ট সহায়তা দেয়।
  • Sheba.xyz: অনলাইনে কেয়ার গিভার বুকিং সার্ভিস দেয়।
  • Nursing Home Care Dhaka: নার্সিং ও কেয়ার সার্ভিসে পরিচিত ব্র্যান্ড।
  • Patient Aid Bangladesh: হাসপাতাল ও বাসায় প্রশিক্ষিত কেয়ার গিভার সরবরাহ করে।

ভবিষ্যতে কেয়ার গিভার পেশার সম্ভাবনা

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগামী ৫–১০ বছরে এই সেক্টরে প্রতি বছর হাজার হাজার কেয়ার গিভার প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

  1. বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান
  2. নার্সিং ও হোম কেয়ার সার্ভিসের প্রসার
  3. বিদেশে প্রশিক্ষিত কেয়ার গিভার পাঠানোর প্রকল্প
  4. স্থানীয় হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চাহিদা বৃদ্ধি

এছাড়া, কেয়ার গিভার পেশা নারীদের জন্যও নিরাপদ ও মানবিক একটি ক্যারিয়ার হিসেবে গড়ে উঠছে।

পরামর্শ: কেয়ার গিভার হতে চাইলে কী করবেন?

১. প্রথমে একটি ভালো ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন।

২. বেসিক ইংরেজি ও কমিউনিকেশন স্কিল উন্নত করুন।

৩. ইন্টার্নশিপ বা প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং নিন।

৪. সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে অনলাইন প্রোফাইল তৈরি করুন (যেমন workupdeal.com, BDJobs, Sheba.xyz ইত্যাদিতে)।

৫. অভিজ্ঞতা অর্জনের পর বিদেশে আবেদন করতে পারেন।

উপসংহার: বাংলাদেশে কেয়ার গিভার পেশা শুধু একটি চাকরি নয় — এটি মানবিক সেবার এক মহৎ ক্ষেত্র। একজন কেয়ার গিভার অসুস্থ ব্যক্তির জীবনে আশা ও সাহচর্য ফিরিয়ে আনেন।

🔹 লেখক: Sohel Rana
🔹 ওয়েবসাইট: workupdeal.com
🔹 বিভাগ: পেশা ও প্রশিক্ষণ


Avatar

Shohel Rana

CEO & Founder

Enjoy the little things in life. For one day, you may look back and realize they were the big things. Many of life's failures are people who did not realize how close they were to success when they gave up.

Cookie
We care about your data and would love to use cookies to improve your experience.