মোবাইল ব্যাংকিং এ নিরাপদ থাকার উপায়ঃ সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যাপক প্রসার লাভ করছে। সহজে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থ স্থানান্তর এবং কেনাকাটার দারুণ সুবিধা থাকায় গ্রাহক নিজের মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট খুলছেন।
মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মধ্যে জনপ্রিয়, ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের রকেট, ডাক বিভাগের নগদ প্রভৃতি সেবায় প্রতিদিন রেজিস্ট্রেশন করছেন প্রচুর পরিমাণ নতুন নতুন গ্রাহক। মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় নিরাপদ থাকার জন্য যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে বা যেসব বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে সে ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দেওয়া হবে আজকের আর্টিকেলে।
মোবাইল ব্যাংকিং এর নিরাপত্তা পরামর্শ ২০২৩
আজকের আর্টিকেলে যেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে সবগুলো মোবাইল ব্যাংকিং এর নিরাপত্তার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
১. মোবাইল ব্যাংকিং এর পিন নম্বর গোপন রাখুন
আপনার যদি একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট খোলা থাকে (যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়) তবে প্রত্যেকটি মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের জন্য আলাদা আলাদা পিন নাম্বার সেট করুন। যেমনঃ বিকাশের একটা পিন, নগদের আলাদা আরেটা পিন এবং রকেটের অন্য আরেকটা পিন। তবে সহজ কোন পিন নাম্বার ব্যবহার করবেন না। অনেকে আছে মোবাইল নাম্বারের শেষের কয়টি সংখ্যা পিন হিসেবে ব্যবহার করে। এমনি কখনো করবেন না। সবসময় চেষ্টা করবেন এমন পিন নম্বর দিতে যেটা কেউ সহজে অনুমান করতে পারবেনা। আর এই পিন নাম্বার কখনো কাউকে বলবেন না। একটা বিষয় মনে রাখবেন, কেউ যদি আপনার পিন নাম্বার জেনে যায় তাহলে সে আপনার মোবাইল থেকে টাকা তুলে নিতে পারবে।
২. ভুয়া “কাস্টমার কেয়ার” থেকে সাবধান
আপনার মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের পিন নাম্বার শুধু আপনারই জানা উচিত- আর কারো না। সেটা হতে পারে বিকাশ, নগদ বা রকেটের পিন। মনে রাখবেন, ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার থেকে কখনোই আপনার পিন নাম্বার জানতে চাইবে না। যদি কেউ কাস্টমার কেয়ারের ভুয়া পরিচয় দিয়ে আপনার মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট (যেমনঃ বিকাশ, নগদ, রকেট) পিন নাম্বার কিংবা ভেরিফিকেশন কোড জানতে চায়, তাহলে পিন নাম্বার না দিয়ে বরং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং সেবার কাস্টমার কেয়ারে কল দিয়ে অভিযোগ করুন।
৩. সঠিকভাবে নিজের তথ্য দিয়ে নিবন্ধন করা সিমে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট খুলুন
আপনার সিমের নিবন্ধন যদি সঠিক না হয় তাহলে সেটি যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা অন্য কেউ সেই সিম তুলেও নিয়ে যেতে পারে। এছাড়া যেকোনো সময় সিম হারিয়েও যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আপনার কাছে যদি সিমের বৈধ কাগজপত্র থাকে তাহলে সহজেই সিম রিপ্লেস করে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু কাগজপত্র না থাকলে বা নিজের সঠিক তথ্য দিয়ে সিম রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকলে, সিম তুলতে পারবেন না- সেক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে থাকা টাকা আর ফেরত না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সুতরাং এই বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।
৪. লটারি, পুরষ্কার, জ্বীনের বাদশা এসব থেকে সাবধান!
অনেকেই হয়তো এগুলো শুনে থাকবেন, অপরিচিত মোবাইল নাম্বার থেকে কল করে হটাৎ বলা হয় “আপনি এতো লাখ টাকার লটারি জিতেছেন, অমুক নাম্বারে এত টাকা বিকাশ করলেই টাকা পাবেন”, কিংবা “জ্বীনের বাদশা” সেজে অনেকে কল করে বিকাশ করতে বলে। তখন অনেকেই এসবের লোভে পড়ে মোবাইলে টাকা পাঠিয়ে দেয়। অতি লোভ করা ভাল না। সুতরাং এসব প্রতারকের ফাঁদ থেকে সাবধান হোন। প্রতারকের মোবাইল নম্বরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুরো ব্যাপারটি অবহিত করুন এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কাস্টমার কেয়ারে কল দিয়ে অভিযোগ করুন।
৫. নকল মেসেজ ও ভুয়া কলের ব্যাপারে সাবধান!
বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক সেবা ব্যবহার করে নিজের ইচ্ছেমত নাম্বার বানিয়ে সেগুলো থেকে মেসেজ পাঠানো যায়, এমনকি কলও করা যায়। এগুলো খুবই বিপজ্জনক। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, উদাহরণস্বরূপ, নগদ থেকে যে মেসেজগুলো আসে সেগুলোর মেসেজ প্রেরকের নামের স্থলে “Nagad” লেখা থাকে- অর্থাৎ মেসেজটি Nagad (নগদ) থেকে এসেছে। এখন কেউ যদি অনলাইনের মেসেজিং সেবার মাধ্যমে আপনাকে Nagad সেজে মেসেজ দেয় এবং তাতে যদি লেখা থাকে যে, আপনার মোবাইলে ৫০ হাজার টাকা এসেছে তাহলে আপনি অবশ্যই অবাক হবেন।
অনেকেই আপনাকে এরকম প্রতারণামূলক মেসেজ পাঠিয়ে। তারপর আবার আপনার মোবাইলে কল করে বলবে যে “ভাই ভুলে আপনার নগদে এত হাজার টাকা চলে গেছে একটু তাড়াতাড়ি আমাকে ফেরত দেন।” তখন আপনি হয়ত সরল মনে মেসেজ দেখেই সাথে সাথে নগদে ডায়াল করে টাকা দিতে উদ্যত হবেন। থামুন! এরকম মারাত্নক ভুল কখনও করবেন না যেন! প্রত্যেকবার মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে টাকার মেসেজ আসলে নিজে মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর ডায়াল করে অথবা অ্যাপে লগইন করে ব্যাল্যান্স চেক করবেন। সরাসরি কল বা মেসেজের উপর মোটেই বিশ্বাস করবেন না।
উদাহরণস্বরূপ, নগদ থেকে মেসেজ আসলে মেসেজ পড়ে নিজে অবশ্যই *167# ডায়াল করে বা অ্যাপ থেকে নিজের ব্যাল্যান্স চেক করবেন যে একাউন্টে টাকা যোগ হয়েছে কিনা। অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট সেবার একাউন্ট নাম্বার ডায়াল করে বা মোবাইল অ্যাপে ব্যাল্যান্স জেনে নিবেন। আবারও বলছি, কল বা মেসেজের উপর মোটেই ভরসা করে থাকবেন না। তাহলেই যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে।
৬. কোনো নাম্বারে টাকা পাঠানোর আগে কল করে নিশ্চিত হয়ে নিন
যেকোনো মোবাইল ব্যাংকিং নাম্বারে টাকা পাঠানোর আগে নিজ হাতে ফোনে সেই নাম্বার তুলে (বা কনটাক্ট লিস্ট থেকে) কল করে নিশ্চিত হোন যে আপনি টাকা পাঠালে তা সঠিক ব্যক্তির কাছে টাকা যাবে কিনা। নাম্বার ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে মোবাইল নাম্বার হুবহু নকল করে প্রতারকেরা কল করে টাকা চাওয়ার ঘটনা ঘটছে। সুতরাং কোনো পরিচিতজনের নাম্বার থেকে কল আসলে আপনি টাকা দেয়ার আগে অবশ্যই আপনার মোবাইল থেকে সেই ব্যক্তির নাম্বার ডায়াল করে জেনে নিবেন তিনি আসলেই টাকা চাচ্ছেন কিনা। গলার স্বর, প্রয়োজন প্রভৃতিও খেয়াল করে শুনবেন।
৭. নিজ নিজ একাউন্টে লেনদেন করুন
ক্যাশ আউট ছাড়া নিজেদের মধ্যে টাকা লেনদেনের জন্য ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে খোলা মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট ব্যবহার করুন। এতে হিসেব রাখা সহজ হয় ও নিরাপত্তাও বাড়ে।
৮. মোবাইলে মেসেজের জন্য যথেষ্ট জায়গা রাখুন
মোবাইলে নতুন মেসেজ আসার জন্য মেসেজ ইনবক্সে পর্যাপ্ত খালি জায়গা রাখুন। অনেক সময় দেখা যায় ফিচার ফোনের মেসেজবক্স ভরে যায়, ফলে নতুন মেসেজ আসার জন্য জায়গা থাকেনা। এরকম হলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ লেনদেনের মেসেজ আসবে না। সুতরাং নতুন মেসেজের জন্য ইনবক্সে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা খালি রাখুন। মোবাইল কোম্পানির বিভিন্ন অফার ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় মেসেজ মুছে ফেলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মেসেজগুলো সংরক্ষণ করতে পারেন, যা ভবিষ্যতে যেকোনো সময় কাজে লেগে যেতে পারে। তবে অবশ্যই এই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে এসব মেসেজ অন্য কেউ যাতে না দেখতে পারে। কেননা আপনার লেনদেনের বিবরণ দেখে ফেললেও অনেকে বিভিন্ন উপায়ে প্রতারণা করতে পারে।
৯. একাউন্ট ব্যাল্যান্সের হিসেব রাখুন
আপনার মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে কত টাকা জমা আছে সবসময় সেই হিসেবটা মনে রাখুন। জরুরী প্রয়োজনে কাজে লাগতে পারে। যেমন কাস্টমার কেয়ারে কোনো সমস্যায় পড়ে কল দিলে তারা ব্যাল্যান্স ও সর্বশেষ কয়েকটি লেনদেন সম্পর্কে জানতে চাইতে পারে কারন আপনি আসল গ্রাহক কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য। তবে কাস্টমার কেয়ারে কখনোই আপনার পিন নম্বর বা ভেরিফিকেশন কোড জিজ্ঞেস করবেনা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মেসেজগুলোর তথ্যও বেশ স্পর্শকাতর। তাই এগুলো লক করে রাখুন অথবা গোপন কোথাও লিখে রেখে ফোন থেকে মুছে ফেলুন। সবচেয়ে ভালো হয় আপনার মোবাইল কারো হাতে না দিলে।
১০. মোবাইল ফোন হারিয়ে গেলে
হটাৎ যদি আপনার মোবাইল ফোন হারিয়ে যায় আর ঐ মোবাইলে থাকা সিমে যদি মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট খোলা থাকে। তাহলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং সেবার কাস্টমার কেয়ারে কল দিয়ে নিজের একাউন্ট এবং ব্যাক্তিগত তথ্য নিশ্চিত করুন। এবং আপনার মোবাইল ব্যাংকিং এর সিম ও মোবাইল হারিয়ে গেছে সে সম্পর্কে বলুন। তাহলে তারা সাময়িক সময়ের জন্য আপনার একাউন্টের লেনদেন বন্ধ রাখবে। যার ফলে কেউ আপনার একাউন্ট থেকে টাকা উত্তলন করে নিতে পারবেনা। তারপর দ্রুত সময়ের মধ্যে আপনার সিমটি রিপ্লেস করে নিন।